সাম্প্রতিক বার্তা
ইএসডিও’র সহযোগীতায় ঠাকুরগাঁওয়ে পাপোশ তৈরি করে স্বাবলম্বী রুফিনা হেমব্রম
পরিত্যক্ত ঝুটের তৈরি পাপোশে ভাগ্য বদল হয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নের চাপাতি গ্রামের রুফিনা হেমব্রমের। স্থানীয় বাজারসহ সারাদেশে রয়েছে এসব পাপোশের ব্যাপক চাহিদা। উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রমীণ মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। বছরের কয়েক মাস কৃষিকাজ থাকলেও বেশীর ভাগ সময়ে অলস বসে থাকতে হয়। দরিদ্র এসব পরিবার তখন বেশ অর্থ সংকটে পড়ে। আর এসব দরিদ্র পরিবারের নারীদের স্বাবলম্বী করতে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় ইএসডিও । হেকস / ইপার -এর অর্থায়নে ও ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)এর প্রেমদীপ প্রকল্পের মাধ্যমে ২৪৫ জন নারীকে পাপোশ তৈরীর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। শুধু তাই নয় এই ২৪৫ জন নারীকে দেওয়া হয় পাপোশ তৈরির যন্ত্র এবং সরবরাহ করা হয় কাঁচামাল। ২৪৫ জন নারীই সংসারের কাজের পাশাপশি শুরু করেন নিজ বাড়িতে পাপোশ তৈরী ।
প্রশিক্ষণ শেষে কিছুদিন একা পাপোশ তৈরী করে রুফিনা পরিকল্পনা করে সে একটি কারখানা দিবে । এর পরে ইএসডিও থেকে লোন নিয়ে নিজের বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত একটি জমিতে শুরু করেন পাপোশ কারখানা । ধিরে ধিরে লাভের মুখ দেখতে থাকে সে । এখন সে স্বয়ংসম্পূর্ণ । সংসারে নেই আর অভাব অনটন।রুফিনা হেমব্রম বলেন,আমি একসময় খুব অবহেলিত ছিলাম ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী বলে অনেকে কাজে নিতো না। ইএসডিও প্রেমদীপ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তায় পাপোষ তৈরীর কার্যক্রম শুরু করি এখন আমার প্রতি মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা লাভ হয় এবং ২০ জন পিছিয়ে পড়া নারী ও পুরুষ কাজ করছে আমার কারখানায় । আগে আমার পরিবারই আমার মূল্যায়ন করত না কিন্তু এখন আমাকে শুধু পরিবার না গ্রামের অন্যান্য সবাই সম্মান করে এবং বিভিন্নভাবে আমার পরামর্শও নিয়ে থাকে । পাপোষ তৈরির জন্য আমরা যে ঝুটটি ব্যবহার করছি তা বিভিন্ন গার্মেন্স ফ্যাক্টরি আর্বজনা হিসেবে ফেলে দিত যা পরিবেশের ক্ষতি করত । আমরা সেগুলো সংগ্রহ করে কাজে লাগাছি। যার মাধ্যমে একদিকে পরিবেশ দূষন রোধ হচ্ছে এবং আমরা পাপোষ তৈরি করতে পারছি। আমাদের এ কাজের কারণের কমিউনিটির লোকজন এবং স্থাণীয় প্রশাসন আমাদের প্রশংসা করছে। যদি সরকার অমার এই ব্যবসার জন্য স্বল্পসুদে লোন দেয় তাহলে আমি বড় পরিসরে এই কারখানাটি করতে চাই ।
পাপোশ তৈরির পরে পোহাতে হয় না বিক্রি করার ঝামেলাও। বাড়ি থেকেই প্রতি সপ্তাহে পাপোশ গুলো ক্রয় করে নিয়ে যায় একটি প্রতিষ্ঠান। সংসারের কাজের পাশাপাশি এসব পাপোশ তৈরি করে মাসে ৬থেকে ৭ হাজার টাকা আয় করছেন গ্রামীণ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এই নারীরা। তাদের দেখে উদ্ভূত হচ্ছেন আশেপাশের অন্যান্য নারীরাও। রুফিনা হেমব্রম এর কারখানার শ্রমিক তার্তুল মুর্মু বলেন,আগে আমরা বন জঙ্গল থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে দিন যাপন করতান বনজঙ্গলের সাথে কৃষি জমিও কমে গেছে সে কারণে আমরা বেকার হয়ে পড়েছেলাম । ইশ্বরের আর্শিবাদে এই কারখানাটি হয়েছে এখন আমরা ভাল আছি।
কারখানার শ্রমিক নির্মলা টপ্পো বলেন,মূল সমাজের মানুষ আমাদের কাজে নেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা অনিহা প্রকাশ করে থাকে । আমরা নারীরা মাঝে মধ্যে তাদের বাড়ি ও কৃষি জমিতে কাজ করে থাকি । কাজে নিলেও আমরা সেখানে মজুরি বৈষম্যের স্বীকার হই। এই কারখানায় কাজ করার ফলে আমরা এখন নায্য মুজুরি পাচ্ছি । একই সাথে অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে মূল সমাজের কাছে আমাদের গ্রহনযোগ্যতা বেড়ে গেছে।
ইএসডিও নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান জানান, বাংলাদেশে অনেক প্রশিক্ষণ দেয়া হয় কিন্তু বাজারজাত করতে না পারলে সেটা কাজে আসে না। কিন্তু এটি আমরা প্রাইভেট সেক্টরের সাথে এমন ভাবে মিলিয়ে দিয়েছি যে তার প্রশিক্ষণ যেদিন শেষ হয়েছে সেদিন থেকে তার আয় এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।আমরা প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পাচ্ছি অতি দরিদ্র নারীরা কিভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে এবং দারিদ্র্য মুক্ত হচ্ছে। বিসিক জেলা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক হাফিজুর রহমান বলেন, রুফিনা হেমব্রম সহ অন্য উদ্যোক্তারা যদি আমাদের কাছে ঋণের আবেদন করে সে ক্ষেত্রে আমরা যাচাই বাছাই করে তাদের ঋণের ব্যবস্থা করবো । এ ছাড়াও তারা যদি ব্যবসা ম্যানেজমেন্ট প্রশিক্ষণ সহ পন্য বিদেশে রপ্তানি করতে চায় সেই ক্ষেত্রেও আমরা তাদের সহযোগীতা করবো।
ইএসডিও’র সহযোগীতায় বর্ণিল আয়োজনে ওঁরাও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসব পালিত
ওঁরাও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ও সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব কারাম পূজা। বংশ পরম্পরায় যুগ যুগ ধরে প্রতি বছর ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পাঁচ পীর ডাঙ্গা গ্রাম সহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় ওঁরাও সম্প্রদায় এই কারাম উৎসব পালন করে আসছেন। কারাম উৎসবে তারা তাদের নিজেদের ভাষা, সাংস্কৃতি আর ঐতিহ্য তুলে ধরেন।
সপ্তাহখানেক আগে থেকেই চলতে থাকে পূজার প্রস্তুতি। পূজার আগের রাত থেকে শুরু হয় উপবাস। এটা শেষ হয় বিসর্জনের দিন। পূজা শুরু হয় সন্ধ্যার পরপরই। বেশ কয়েকটি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে নৃত্য-গীতযোগে পূজা করা হয়। পুঁতে রাখা হয় কারাম গাছের ডাল। সেখানে দুধ ছিটিয়ে জ্বালানো হয় ধূপ। পুঁতে রাখা কারামের ডাল ঘিরে সারা রাত নৃত্যযোগে ধর্মীয় গীত করা হয়। ওরাও সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ধর্ম ও কর্মা নামে তাদের ধর্মীয় দুই দেবতার প্রতি এই অর্চনা তাদের যেকোন বিপদ থেকে রক্ষা করবে।
প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ সপ্তাহে অথবা আশ্বিন মাসের প্রথম সপ্তাহে ঠাকুরগাঁওয়ের গোবিন্দনগর, জগন্নাথপুর,পাঁচ পীর ডাঙ্গা, চন্ডিপুরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে ওঁরাও সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ বৃক্ষ পূজা উপলক্ষে কারাম পূজা ও সামাজিক উৎসবের আয়োজন করে থাকেন। আর এই পূজা দেখতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন অনেকেই।
গত মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ঠাকুরগাঁও এর আয়োজনে ইএসডিও থ্রাইভ প্রকল্প সহযোগিতায় সদর সালান্দর ইউনিয়নে পাচপীরডাঙ্গা আদিবাসী গ্রামে ঐতিহ্যবাহী কারাম পূজা ও সামাজিক উৎসবটি পালন করা হয়। উৎসবটি দেখার জন্য ওরাওঁ (আদিবাসী) সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ সমবেত হয়।
আয়োজকেরা জানান কারাম পূজা পালনের জন্য আদিবাসী (ওঁরাও) নর-নারী সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পূজার প্রথম দিন উপোস থাকেন। উপোসের মধ্য দিয়ে কারাম পূজা শুরু করেন ওঁরাও নারীরা। সন্ধ্যায় মাদল, ঢোল, করতাল ও ঝুমকির বাজনার তালে তালে নেচে-গেয়ে এলাকা থেকে কারামগাছের (খিল কদম) ডাল তুলে আনেন তারা। পরে তাঁরা একটি পূজার বেদি নির্মাণ করেন। সূর্যের আলো পশ্চিমে হেলে গেলে সেই কারামগাছের ডালটি পূজার বেদিতে রোপণ করা হয়।
কারাম বৃক্ষের পূজার মাধ্যমে ঢাকের তালে নিজস্ব সংস্কৃতির রেশে তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীরা নেচে গেয়ে এ উৎসবে মেতে উঠেন। সন্ধ্যার প্রথম প্রহরে গান-বাজনার মাধ্যমে কারাম গাছ নিয়ে এসে যথাস্থানে বসানো হয়। তারপরে ঢাকের তালে নেচে গেয়ে উৎসবে মেতে উঠেন আদিবাসীরা।
প্রতিবছর এ উৎসব পালন করা হয়। আদিবাসী ওরাও সম্প্রদায়ের সব থেকে বড় উৎসব এই কারাম পূজা। ২ দিন ব্যাপি এই উৎসবে আদিবাসীদের আত্বীয় স্বজনেরা উপস্থিত থাকেন। নিজেদের বিপদ থেকে মুক্তির জন্য ও দেশের মানুষের মঙ্গল কামনায় কারাম পূজাটি করে থাকে আদাবাসীরা। তারা মনে করে এ পূজার মাধ্যমে তাদের সকল বিপদ-আপদ দূর হয়ে যাবে।
এসময় উপস্থিত ছিলেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন, আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট ইমরান হোসেন চৌধুরী, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ঠাকুরগাঁও জেলা সভাপতি যাকোব খালকো ও সাধারণ সম্পাদক বিশুরাম মুর্মু সহ জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ।
ঠাকুরগাঁওয়ে ৩ দিন ব্যাপী কৃষিখাত সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার ( ২৪ সেপ্টেম্বর ) ইএসডিও কতৃক বাস্তবায়িত পিপিইপিপি-ইইউ প্রকল্পের আয়োজনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ ) ও পল্লী কর্ম – সহায়ক ফাউন্ডেশন ( পিকেএসএফ ) এর অর্থায়নে ও কারিগরি সহযোগিতায় ইয়েসডিওর প্রধান কার্যালয়ের মেধা অনুশীলন কেন্দ্রে এ প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়।